যে পথে সূর্য্য আসে, আর যে দিকে চলে যায় আবার যে পথে শীত আসে আর যে পথ বয়ে আনে কোকিলার সুর- এই ছিলো আমাদের গ্রাম।
নার্গিসের গণ্ড ভিজে আসে। তারপর ঠোঁট নড়ে-
- দাদার আমলে আমাদের গ্রামে সকল ধর্মের মানুষ মিলে-মিশে বাস করতো। কোনোই ঝামেলা ছিলো না। যার নামাজ পড়ার কথা সে মসজিদে যেতো, যার পূঁজা করার কথা সে যেতো মন্দীরে। আর বৌদ্ধরা পড়ে থাকতো বিহারে। আমরা নাকি মন্দীরের নাড়ু খাওয়ার জন্য অস্থির থাকতাম। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এলে মায়ের সাথে ঝগড়া করে তাদের ভিক্ষা দিতাম। সমাজের মধ্যে মোড়লগীরি ছিলো না। হঠাৎ একবার নাকি এক পড়া-লেখা জানা লোক আমাদের গ্রামে এসে বাস করতে চায়। পড়া-লেখা জানা মানুষের মাথায় কতো বুদ্ধি! কী চকচকে তার পোশাক ! মানুষজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনতো। এতো সুন্দর করে কথা যায় ! গ্রামের বুড়ো পণ্ডিত মশাই লেখা-পড়া জানতেন। তার সাথে খুব জমতো ওনার কথাবার্তা।
মুনিব জিজ্ঞেস করে- তুই শুনেছিস সেই কথা ?
নার্গিস জিবে কামড় খায়, দুই হাতে কান ধরে। তারপর আবার মুখ খোলে-
- এ্য মা, আপনে যে কী কন ! তখনতো আমার বাপেরই জন্ম হয় নাই। দাদার মুখে শুনেছি। গল্পের মধ্যে কথা বললে কি গল্প বলা যায় ? আর কথা বলবেন না কিন্তু !
- আচ্ছা বলবো না। এই আমি মুখ বন্ধ করলাম।
- চোখ বন্ধ করবেন না কিন্তু !
- আচ্ছা, তুই বল।
মুনিব বয়সে নার্গিসের ছোটো। কিন্তু তাতে কি ! সে তো আর মুনিব না ! মুনিবের কথা গায় মাখে না। বলতে থাকে-
- পণ্ডিত মশাই লোকটির কথায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কাচারী ঘরে থাকতে দিলেন। কয়েকদিন যেতে না যেতেই সে আমাদের গ্রামে নিজের বাড়ি বানানোর জন্য জায়গা চাইলে, পণ্ডিত মশাই সেই ব্যবস্থাও করে দেন। সে ধীরে ধীরে গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে, তাদের দেশে বেড়ানোর লোভ দেখিয়ে মানুষজনকে তার পক্ষে বানাতে লাগলো। সমাজ সেবার নামে সাদা কাপড় পরা মেয়েরা এলো। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে সেবা দিতে লাগলো। মানুষ তাদেরকে ভালোবাসতে লাগলো। অভাবী ছিলাম আমরা। সামান্য সুবিধা পেয়ে মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে যেতে থাকলো। তারপর শোনা গেলো- সাদা পোষাক পরা লোকেদেরকে পাদ্রী-নান বলে। খবর ছড়িয়ে পড়লো তারা ঘর-বাড়ি, টাকা পয়সার বিনিময়ে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণে মানুষকে প্রলুব্ধ করছে। কেউ কেউ মনে করলো ধর্ম দিয়ে কি হবে, পেটে ভাত না পড়লে কোনো ধর্মই ভালো লাগে না। কিন্তু মন্দীরের পূঁজারী, মসজিদের ইমাম এ কথা মানবে কেনো। ঝামেলা বেধে গেলো। আলাদা আলাদা প্রতিবাদ হতে লাগলো।
মুনিবের পান খাওয়ার অভ্যাস। বার বার থু থু ফেলতে দেখে বুঝতে পারে নার্গিস। সে পাশেই থাকা পান-বাটা থেকে একটা পান তুলে মুনিবের হাতের ধরিয়ে দেয়। মুনিব পান মুখে দিয়ে বলে-
- তোর গল্পটাতো ভালোই লাগছে।
- সত্যি ? নার্গিসের চোখদুটো চকচক করে ওঠে।
- নাহ্। গল্পটা খুব ভালো লাগছে। তোর বলার ঢংও ভালো। তুই যেভাবে বলছিস যেনো তোর চোখে দেখা ছবির বিবরণ দিচ্ছিস।
- নিজের গ্রামের কথা। এ কথার সাথে অন্তরের ব্যথা জড়িয়ে রয়েছে।
- নে নে, তাড়াতাড়ি শেষ কর।
নার্গিস একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বুকের ভেতরের আত্মা আহত পাখির মতো কঁকিয়ে ওঠে। ভিজে ওঠে চোখের কোণা। এই বুকের উপরেই স্টীম চালিয়েছে অমলেরা। অপারেশনের পর অপারেশন করে দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। নি:শ্বাস ফেলার অধিকারও যেনো নেই তার। শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে ওঠে তার। আঁচলের দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করে-
- ধর্ম না থাকলে তাদের চাকরী থাকবে কি ! তারাও ঘরে ঘরে যেতে শুরু করে। মানুষকে একত্রিত করতে যা যা করার তাই তাই করতে আরম্ভ করে। ধর্মও বাদ গেলো না। তুমুল গণ্ডগোল হলো। এক পর্যায়ে সে গেলো ঠিকই, কিন্তু আমাদের মধ্যে বৈষম্যের বীজ বপন করে গেলো।
- তারপর কি হলো ?
- তারপর, আমরা আগে যেমন মিলে মিশে বাস করতাম- সেই মিলের জায়গায় আর ফিরে যেতে পারলাম না। আমরা যে কয় ঘর মুসলমান ছিলাম, তাদের জন্য এলাকা ভাগ করে দেয়া হলো। চারপাশে হিন্দু ভাইবোন, আমরা পড়ে গেলাম মাঝখানে।
গল্পের এ পর্যায়ে এসে নার্গিস থেমে যায়। মুনিবও কেমন যেনো সন্দেহে পড়েছে। এই গল্পটা তারও যেনো চেনা চেনা মনে হচ্ছে। নার্গিস তাকে এই গল্প দ্বারা কী বুঝাতে চাচ্ছে। মুখের মধ্যে থাকা পান তার কাছে বিস্বাদ লাগে। এতোক্ষণ নার্গিসের যেই গল্পে সে আনন্দ অনুভব করছিলো, সেই আনন্দ তার মুছে গেছে। নার্গিসকে বলে-
- নে গল্পের শেষ বল।
- এ গল্পের শেষ নাই মালিক। চলেন, আপনার গোসলের সময় হয়ে গেছে। পানি তুলে দিই।
- আমার সাথে চালাকী !
মুনিব জেনে গেছে গল্পের হেতু। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে। রাগ সম্বরণ করতে না পেরে, নার্গিসের চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ায় মুখের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষত দিয়ে দর দর করে রক্ত গড়াতে থাকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নার্গিস।
-
২০.০৫.২০২২
Post a Comment